সব গল্পের নাম থাকে না - তাসনীম মুন | ১২ ই জানুয়ারি, ২০২০
শীতের সুন্দর সকাল। আজ তেমন কুয়াশা পড়ে নি। মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণ পরেই রোদ উঠে যাবে। আমি একা বারান্দায় বসে ডায়েরি লিখছি। অলকানন্দা, তোমাকে মিস করছি প্রচন্ড। আমি অবশ্য আগেই জানতাম তোমাকে মিস করব। তবুও কাজটা করতে হলো। কিছু কাজ না চাইতেও করতে হয়। প্রকৃতি বাধ্য করে আমাদের।
এই যেমন ধরো আমার মায়ের কথা। আমার বাবা ফরেস্ট অফিসার ছিলেন, বলেছিলাম তো তোমায়? আমি কিন্তু তোমায় কখনো আমার মায়ের কথা বলিনি। হয়ত বলতাম, কিন্তু তুমি সুযোগ দিলে কই? তার আগেই চলে গেলে আমাকে ছেড়ে!
বাবা মাকে- না মা বলছি কেন- আমার জন্মদাত্রী মহিলাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু সেই ছলনাময়ী টাকা আর শারীরিক ভোগবিলাসের জন্য আমার বাবাকে কষ্ট দিয়েছিল, তাঁর ভালোবাসার সাথে বেঈমানি করেছিলো।
আশ্চর্যের কথা কি জানো, এতকিছুর পরেও বাবা তাকে এতটুকু দোষারোপ করেননি। বাবা বলতেন তিনি ঘৃণা করেন ওই মহিলাকে; কিন্তু আমি জানতাম, বাবা আসলে ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসা বাবা চেয়েও মুছতে পারেননি মন থেকে। বাবা আসলে ছিলেন প্রচন্ড আবেগপ্রবণ, দুর্বল লোক।
কিন্তু আমি আমার বাবার মতো দুর্বল নই। আমি অনুভূতিশূন্য। 'ফরগিভ, বাট ডোন্ট ফরগেট', এই ধরনের গাঁজাখুরি কথায় আমি বিশ্বাস করিনা। নাইদার আই ফরগেট, নর আই ফরগিভ। তাই আমার মাকে আমার বাবা ক্ষমা করলেও, আমি করিনি।
জানো অলকানন্দা, আমার এখনো মনে পড়ে তোমার সাথে আমার কিভাবে দেখা হয়েছিল। ম্যাক্সের কাছে শুনেছিলাম রাস্তার পাশের কটেজে নতুন মালিক এসেছে৷ বিকেলে জগিং করতে গিয়ে দেখলাম গাড়ি থেকে লম্বা কালো চুলের তুমি কার্টনের বক্স নামাচ্ছো। সেই রেশমের মতো চুলের প্রেমে পড়ে গেলাম আমি। জানো, আজো তোমার চুল জড়িয়ে না ঘুমোলে আমার ঘুম আসেনা।
এরপর প্রতিদিন তোমাকে দেখতাম, তুমিও আমাকে দেখতে। এরপর একদিন সাহস করে কথা বলেই ফেললাম। বন্ধুত্ব হলো, প্রেম হলো, পরিণয় হলো। তুমি সারা পৃথিবীকে সাক্ষী রেখে বলেছিলে আমি তোমার, তুমি আমার।
কিন্তু তুমি মিথ্যে বলেছিলে অলকা। আমার জন্মদায়িনী যেভাবে আমার বাবাকে ঠকিয়েছিল, ঠিক সেভাবে তুমিও আমায় ঠকালে। আচ্ছা, তোমরা মেয়েরা এমন ছলনাময়ী কেন?
আমাদের প্রথম রাতে তুমি আমায় কি বলেছিলে, মনে আছে অলকা? তোমার হৃদয়ের ওপর আমার হাত রেখে বলেছিলে, এই হৃদয় আমার। এখানে শুধু আমার নাম, আমার জন্যই স্পন্দন। তোমার আসল সত্যি জানবার পরে আমার খুব আগ্রহ হয়েছিল তোমার হৃদয় দেখতে। তাই তুমি বেঁচে থাকতেই নিয়ে নিয়েছিলাম। তোমার হৃদয় কেমন যেন কালচে লাল। ঠিক আমার মায়ের মতো। তোমার মধ্যে এত কালো, তা আগে আমি কেন দেখতে পাইনি অলকা?
জানো, আজকাল রাস্তায় বেরোলে সব মেয়ের মুখেই আমি তোমার মুখ দেখি। সহ্য হয় না। বারবার তোমার বেঈমানির কথা মনে পড়ে। এখন আমার ল্যাবরেটরিতে ২৪ টা হৃদয়। প্রত্যেকটা জারের উপরে নাম লেখা আছে। ২৪ টা হৃদয়ের রং ই আমি শুধু কালচে লাল দেখি।
আমার মাথায় একটা জিনিস এসেছে, অলকা। বলতে পারো, হুট করেই এসেছে। আমি আমার ডায়েরিটা বই হিসেবে ছাপাবো। সবাই জানবে আমি কি করেছি, কেন করেছি, আমার সব অভিজ্ঞতা। কিন্তু কি নাম দেব বুঝতে পারছি না। নামেরই বা কি দরকার। সব গল্পের নাম থাকে না, তার দরকারও নেই।
আমি ঠিকই বলেছিলাম অলকা। রোদ উঠে গেছে। শীতের রোদ বড়ই প্রশান্তিকর। তোমার সাথে পোহাতে পারলে ভালো হতো। আফসোস তুমি নেই।
তোমাকে বড্ড মিস করছি, অলকানন্দা।
এতক্ষণ বসে বসে কেমিস্ট্রির প্রফেসর ড. আরশাদ কামালের ডায়েরি পড়ছিলো হোমিসাইড ইনভেস্টিগেশন টিমের হেড এসপি অরিত্র। পুরোটা ডায়েরি পড়ে শিউরে উঠেছে সে। লোকটা সবই লিখে রেখেছে। কি করে নিজের মা আর স্ত্রীসহ ২৪ জন মহিলাকে নৃশংসভাবে খুন করেছে, বডি কিভাবে ডিজপোজ করেছে, তার সবই লিখে রেখেছে। বেঁচে থাকতেই প্রত্যেকের চোখ আর আঙুলের ফিঙ্গারটিপ উঠিয়ে নিত সে। তারপর জ্যান্ত থাকতেই হার্ট বের করে নিত। বোন ডিজপোজ করে দিত কেমিক্যালে। এই ভয়ানক সিরিয়াল কিলারকে ধরতে পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট মরিয়া হয়ে উঠেছিলো। নানা হাত ঘুরে শেষে কেস আসে অরিত্রের কাছে। ও-ই এক মাসের রোমহষর্ক তদন্তের পরে কেস সলভ করে প্রফেসরকে গ্রেফতার করে।
অরিত্র এরপর জেলে গেল প্রফেসরের সাথে দেখা করতে। মাঝবয়সী প্রফেসর বই পড়ছিলেন। লোকটাকে প্রথমবার দেখলেই কেমন শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে। কে বলবে, ওঁর মধ্যে অমন অন্ধকার আছে?
অরিত্র সেলে ঢুকে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো প্রফেসরের সামনে।
-কেমন আছেন প্রফেসর?
-আরে অফিসার অরিত্র যে! বেশ ভালো আছি, তা আপনি কেমন আছেন?
আরে ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন? আমি সত্যিই ভালো আছি। অন্তত বাইরের দুনিয়া থেকে ভালো। জেলের বাইরে কেমন একাকী, অনুভূতিহীন লাগত। জেলে আসার পরে অনুভব করলাম, আমার আর তা লাগছে না। বরং কেমন যেন নিজেকে মুক্ত অনুভব হচ্ছে। একটা বোঝা যেন নেমে গেছে মন থেকে।
-প্রফেসর, আপনার ডায়েরি আমি পড়েছি, মাফ করবেন। ওটা এখন আপনার বিরুদ্ধে আমাদের কাছে অন্যতম প্রধান এভিডেন্স।
অরিত্রের এই কথায় প্রফেসর চুপ হয়ে গেলেন।
অরিত্র আবারো মুখ খুললো, 'আপনার ঘরে যে চুলের গোছা পাওয়া গেছে, তা আপনার স্ত্রী অলকানন্দার, তাই না? অবশ্য ফরেনসিক শীঘ্রই রিপোর্ট দেবে, তবে ডায়েরি পড়ে ওইটুকু আমি নিশ্চিত।'
-হ্যাঁ, ওই চুল অলকার। ওর চুলের গন্ধ ছাড়া আমার ঘুম আসেনা। তাই ওর হার্টের সাথে ওর চুলও রেখে দিয়েছিলাম।
-কেন এমন করলেন, প্রফেসর?
একটু ম্লান হেসে প্রফেসর বললেন, 'একটু আগেই বললেন ডায়েরিটা পড়েছেন, তারপরেও জিজ্ঞেস করছেন?'
একটু থেমে আবার শুরু করলেন প্রফেসর, 'আপনার আমার থেকে ধন্যবাদ পাওনা আছে অফিসার। আমাকে আপনি বাঁচিয়েছেন। এখন আর আমার পরিণতি নিয়ে কোনো ভাবনা নেই।
আপনার কাছে শেষ একটা চাওয়া আছে আমার। রাখবেন?'
-বলুন। সাধ্যমতো চেষ্টা করব।
- আমি আমার ডায়েরিটা বই হিসেবে ছাপাতে চাই। এটাই আমার শেষ এবং একমাত্র চাওয়া। তবে এর কোনো নির্দিষ্ট নাম আমি দেব না।
কিছুক্ষণ প্রফেসরের দিকে চেয়ে থেকে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো অরিত্র। "আমি চেষ্টা করব, প্রফেসর। বিদায়", বলে বের হয়ে গেল জেল থেকে। পরশু প্রফেসরের হেয়ারিং। স্পেশাল দ্রুত ট্রাইব্যুনালে বিচার হবে। সবাই অবশ্য এখনি জানে কি রায় হবে। অরিত্রকে অফিসে গিয়ে প্রফেসরের হেয়ারিংয়ের ফাইনাল কাগজপত্র গোছাতে হবে।
সেল থেকে অরিত্র চলে যাবার পরে প্রফেসর আবার বই পড়ায় মন দিলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হলো, অরিত্র যে চেয়ারে বসে ছিল সেখানে এখন অন্যকেউ বসে আছে। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন, অলকানন্দা।
প্রফেসর চমকালেন না। মৃদু,স্নিগ্ধ হাসলেন।
মাস দুয়েক পর।
কাল ভোরে প্রফেসরের ফাঁসি কার্যকর হবে। তিনি এখন নিজের সেলে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। কিছুক্ষণ আগে শেষ ইচ্ছে জানতে চেয়ে এসেছিলো জেলার। প্রফেসর গম্ভীর স্বরে উত্তর দিয়েছিলেন, " এসপি অরিত্রকে তো আগেই বলেছি। ওনাকে জিজ্ঞেস করে নেবেন।"
একটু পরে কারোর সেলে ঢোকার শব্দ শুনলেন প্রফেসর।
-প্রফেসর।
- আরে, অফিসার অরিত্র যে!
একটা প্যাকেট হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিল অরিত্র,
-আপনার শেষ ইচ্ছে পূরণ করেছি আমি। এই নিন।
আমি আসছি এখন।
অরিত্র বেরিয়ে গেল। লোকটার সামনে কেন জানি থাকতে চাইছিলোনা সে।
প্রফেসর কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেটটা খুললেন। প্যাকেটের ভেতর একটা লাল কালো মলাট দেওয়া বই। মলাটে লেখা, "সব গল্পের নাম থাকে না।"
গল্পঃ "সব গল্পের নাম থাকে না"
তাসনীম মুন,
এইচআর ম্যানেজার,
রাইটার্স ক্লাব বিডি।
